বাংলাদেশে নার্সভুক্ত (NARS) প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) একটি অন্যতম ও একক প্রতিষ্ঠান যার প্রধান কাজ হলো পরমাণু শক্তির শান্তিপূ্ণ ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষি খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে তাৎপর্য্পূণ অবদান রাখা। ঢাকায় তদানীন্তন আণবিক শক্তি কমিশনের একটি. ছোট্ট রেডিও-ট্রেসার ল্যাবরেটরিতে (RAGENE) এর প্রথম যাত্রা শুরু ১৯৬১ তে, যাকে কেন্দ্র করে ১৯৭২-এর জুলাইয়ে একটি অধিকতর সংগঠিত ব্যবস্থাপনায় ঢাকার বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনের “পরমাণু কৃষি ইনস্টিটিউট (ইনা)” গড়ে ওঠে। প্রতিষ্ঠানটি ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে স্থানান্তরিত হয় ১৯৭৫ সালে। ইনা ১৯৮২ সালে “একটি স্বতন্ত্র কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা” লাভ করে এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের আওতায় ন্যস্ত হয়। ১৯৮৪ সালের অধ্যাদেশ নং-২ জারি করে প্রতিষ্ঠানটিকে জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং এর নতুন নামকরণ করা হয় বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা)। বিনা অধ্যাদেশ ১৯৯৬ সালে অ্যাক্ট নং-৪ মূলে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ কর্তৃক সংশোধিত হয়ে আইনে পরিণত হয়।
ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) ক্যাম্পাসে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) প্রধান কার্যালয়ের অবস্থান। প্রতিষ্ঠানটি ময়মনসিংহ রেল স্টেশন থেকে ৫ কিমি দক্ষিণে এবং ঢাকা থেকে প্রায় ১২৫ কিমি উত্তরে অবস্থিত। বাকৃবি ক্যাম্পাসের ৩৩ একর জায়গা জুড়ে এর অবকাঠামো ও আনুষঙ্গিক সুবিধাবলী গড়ে উঠেছে। অফিস ক্যাম্পাস ছাড়াও ময়মনসিংহ শহরের কাঠগোলা এলাকায় ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল মহাসড়কের পাশে ৮.২ একর জায়গায় এর আরেকটি আবাসিক ক্যাম্পাস রয়েছে।
মুখ্য নির্বাহী হিসেবে মহাপরিচালক বিনা’র সার্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করেন, এই দায়িত্ব নির্বাহে তাঁকে পরিচালক (গবেষণা), পরিচালক (প্রশাসন ও সহায়কসেবা) এবং পরিচালক (প্রশিক্ষণ ও পরিকল্পনা) সহায়তা দান করে থাকেন। ইনস্টিটিউটের যাবতীয় কার্যাবলিতে সাধারন নির্দেশনা, প্রশাসন ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব একটি ম্যানেজমেন্ট বোর্ডের উপর ন্যস্ত। প্রতিষ্ঠানের নীতি সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি বোর্ড কর্তৃক নিষ্পন্ন করা হয়। প্রতিষ্ঠানের মুখ্য নির্বাহী হিসেবে মহাপরিচালক পদাধিকার বলে ম্যানেজমেন্ট বোর্ডের চেয়ারম্যান।
বিনা’র প্রধান কার্যালয়, আঞ্চলিক গবেষণা কেন্দ্র ও এর উপকেন্দ্রগুলোতে নিয়োজিত জনবলের সংখ্যা ৫৭৮ জন। এঁদের মাঝে রয়েছেন মহাপরিচালক- ১, পরিচালক- ৩, বিজ্ঞানী- ১৭০, প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা- ৩৬, দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা- ৪০, তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী- ২১১ এবং চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী- ১১৭ জন। বিজ্ঞানীদের মধ্যে ৫০ জন পিএইচডি ডিগ্রীধারী।
প্রধান কার্যালয়ের মোট ১১ টি বিভাগের সমন্বয়ে বিনা’র গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। বিভাগগুলো হলোঃ উদ্ভিদ প্রজনন, মৃত্তিকা বিজ্ঞান, ফসল শারীরতত্ব, কীটতত্ত্ব, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব, কৃষিতত্ত্ব, কৃষি প্রকৌশল, প্রশিক্ষণ, ফলিত গবেষণা ও সম্প্রসারণ, বায়োটেকনোলজি, উদ্যানতত্ব ও কৃষি অর্থনীতি। এছাড়া গাজীপুরের শ্রীপুরে ০১ টি আঞ্চলিক গবেষণা কেন্দ্র সহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল যেমন- রংপুর, ঈশ্বরদি, মাগুরা, সাতক্ষীরা, কুমিল্লা, জামালপুর, খাগড়াছড়ি, সুনামগঞ্জ, শেরপুর, বরিশাল, গোপালগঞ্জ, নোয়াখালী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে বিনা’র মোট ১৩ (তেরো)টি উপকেন্দ্র রয়েছে।
বিনা’র প্রায় প্রতিটি ল্যাবরেটরি আধুনিক বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতিতে সমৃদ্ধ, এছাড়া ময়মনসিংহের প্রধান কার্যালয়, একটি আঞ্চলিক গবেষণা কেন্দ্র ও তেরোটি উপকেন্দ্রে তিনটি গ্লাসহাউজ সহ মাঠ গবেষণা সুবিধা বর্তমান। উল্লেখযোগ্য যন্ত্রপাতির মধ্যে রয়েছে গামা (Co-60) সোর্স, N-15 অ্যানালাইজার, লিকুইড সিন্টিলিশন কাউন্টার, ফ্লরেসেন্ট ও ফেজ কনট্রাস্ট মাইক্রোস্কোপ, বায়োলগ, গ্যাস ক্রোমাটোগ্রাফ, এইচপিএলসি, পিসিআর, জেল ইলেক্টোফোরেসিস, জেল ডক, অ্যাটমিক অ্যাবজর্পশন স্পেকট্রোফটোমিটার, -৮০ডিগ্রী সে. ফ্রিজার, পোর্টেবল ফটোসিনথেসিস সিস্টেম, ইউভি স্পেকট্রোফটোমিটার, ফার্মেন্টার, নিউট্রন ময়েশ্চার মিটার, আইসোটোপ রেশিও মাস স্পেকট্রোমিটার প্রভৃতি। এছাড়া দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মাটির নমুনা সংবলিত একটি সমৃদ্ধ মৃত্তিকা জাদুঘর এখানে গড়ে তোলা হয়েছে।
দশটি বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনা’র গবেষণা কাজ পরিচালিত হয়, সেগুলো হলোঃ (১) কৃত্রিম মিউটেশনের মাধ্যমে উন্নত শস্যজাত, (২) বায়োটেকনোলজি, (৩) মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনা ও জীবাণুসার, (৪) সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা, (৫) বালাই ব্যবস্থাপনা, (৬) শস্য উৎপাদনশীলতার শারীরতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য, (৭) ফসল ব্যবস্থাপনা, (৮) উদ্যান ফসলের উন্নয়ন, (৯) প্রযুক্তির হস্তান্তর ও প্রভাব মূল্যায়ন, এবং (১০) আর্থ-সামাজিক গবেষণা।
পরমাণু শক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে বিনা এযাবৎ ১৯ টি গুরুত্বপূর্ণ ফসলের মোট ১২৫ টি উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেছে এবং দেশের কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে অবদান রেখে চলছে। এছাড়াও, বিনা সাফল্যের সাথে উদ্ভাবন করেছে শিম, ডাল ও তেল জাতীয় ৯ টি ফসলের জন্য জীবাণুসার, যা মাটির গুণাগুণ রক্ষাসহ ডাল ও তেলজাতীয় ফসলের বৃদ্ধির জন্য নাইট্রোজেন সারের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হচেছ।